রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন স্থানে মাটি ধস, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, নানিয়ারচর ও রাজস্থলীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

রাঙ্গামাটি

॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥

অব্যাহত ভারী বর্ষণে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থানে মাটি ধসে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও সড়কে পাহাড় ধসে স্বাভাবিক যান চলাচলে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। টানা বৃস্টির ফলে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যাওয়ায় রাঙ্গামাটি পৌর এলাকার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে পাহাড় ধ্বসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ৭ আগষ্ট ভোরে লোকনাথ বাবা আশ্রম এলাকায় সিএন্ডবির গোডাউনের পাশে একটি বাড়ী ধ্বসে পড়ে যায়। আরেকটি বাড়ীতে পাহাড়েন মাটি ধ্বসে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একই সাথে কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়েছে শত শত লোকজন। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি ও রাজস্থলী উপজেলায় রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে লোকজন চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে রাস্তার উপর মাটি ধসে পরে এবং গাছ উপড়ে পরে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। অবশ্য প্রশাসনের তদারকিতে দ্রæত সময়ের মধ্যে এসব মাটি ও গাছ সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে।

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে রাঙ্গামাটি জেলায় ভারী বর্ষণে ১৯৭ টি স্থানে ক্ষুদ্র ও মাঝারী পরিসরে ভাঙ্গন ও পাহাড় ধ্বসের সৃস্টি হয়েছে। পাহাড় ও ভ’মিধসের কারণে ৩৮১ টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১৩ টি। যানবাহন চলাচলের সড়ক ৭৫ সানে ছোট বড় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সড়কের ৯ টি স্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। ১৪ টি ব্রীজ/কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১৬ টি বিদ্যুতের খুটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পুরো জেলায় ৬৮৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৪৩ টি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ১০ জন আহত হয়েছে এবং ১ জন পানিতে ডুবে নিখোঁজ রয়েছেন। পাহাড়ী ঢলের কারণে আকষ্মিক বন্যার পানিতে ১২৪ টি ঘর এবং ৫ টি বাজার তালিয়ে গেছে। বিলাইছড়ি উপজেলার ১ টি ইউনিয়ন এবং জুরাছড়ি উপজেলার ৪ টি ইউনিয়ন আকষ্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় প্রচন্ড ¯্রােতের কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।

এদিকে, অব্যাহত টানা বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটির দশ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস ও বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাঙ্গামাটিতে সীমান্ত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি ও রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, নানিয়ারচর, বরকলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আর ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এইসব উপজেলার অন্যান্য এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশংকা করছে স্থানীয়রা। এইসব উপজেলাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রিতদের শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুমানা আক্তার বলেন, বাঘাইছড়িতে টানা ভারী বর্ষন ও উজান থেকে নেমে আশা পাহাড়ি ঢলে বাঘাইছড়ি উপজেলার কাঁচালং নদীর পানি বেড়ে এরই মধ্যে নিচু অঞ্চল সমূহ প্লাবিত হতে শুরু করেছে। উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের করেঙ্গাতলী সড়ক ও পৌর এলাকার উগলছড়ি সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের উগলছড়ি, বেপারী পাড়া, নিউলাইল্ল্যা ঘোনা এবং পৌরসভার বটতলী, মাদ্রাসা পাড়া, হাজী পাড়ার কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। ভারী বর্ষণের ফলে মারিশ্যা-দীঘিনালা সড়কে দুইটিলা এলাকায় দুইবার পাহাড় ধসের ঘটনায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে সড়ক জনপদ বিভাগ প্রায় ২ ঘন্টার চেষ্টায় যান চলাচল স্বাভাবিক করে তোলে।

এছাড়া বন্যার আশংকায় উপজেলা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া আনসার ভিডিপির সদস্যদের উদ্ধার কাজে মাঠে রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে, জুরাছড়ি উপজেলা টানা ভারী বর্ষনে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আউশ মৌসুমে ২০২ হেক্টর জমির রোপিত ধান ও প্রায় ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।

জুরাছড়ির দুমদুম্যা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাধন কুমার চাকমা বলেন, জুরাছড়ি ইউনিয়নের লুলাংছড়ি, সাপছড়ি, সীতারামপাড়া, মিতিংগাছড়ি, ডেবাছড়া কুসুমছড়ি, বালুখালী, মধ্যভিটা, শীলছড়ি, ঘিলাতলী বনযোগীছড়া ইউনিয়নে বহেরাছড়ি, ধামাইপাড়া, ছোট পানছড়ি, বেকাবেক্যা, শুকনাছড়ি, চুমাচুমি, মৈদং ইউনিয়নের পানছড়ি, ভুয়াতলী, জামের ছড়ি, হাজাছড়ি, বারাবান্যা দুমদুম ইউনিয়নে ডানেতেছড়ি, বস্তিপাড়া, বরকলক, করইদিয়া, চাম্পাইপাড়া ও গবছড়ি বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল নামায় নিম্ন অঞ্চলে বসবাসরতদের আতংকে রয়েছে।

জুরাছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার চাকমা বলেন, উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির এলাকা পরির্দশন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদেন সহায়তায় তালিকা তৈরীর করে জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বড় ধরনেন ক্ষয়ক্ষতির এরাতে পুলিশ ও উপজেলা পরিষদের একটি টিম মাঠে কাজ করছে।

অন্যদিকে, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ী এলাকা রাজস্থলীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজস্থলী উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের হাজীপাড়া যাওয়ার রাস্তার বেইলি ব্রিজটি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তবে অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আশংকায় পাহাড়ের নিজস্ব বসবাসরতদের নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে সরাতে এবং সতর্ক করতে উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।

বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আদোমং মারমা বলেন, বাঙ্গালহালিয়া ডাকবাংলা পাড়ায় কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে বাঙ্গালহালিয়া বাজারসহ দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের পিছনের দিকে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে বড় ধরনের কোন প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানান।

এদিকে, রাঙ্গামাটি কাপ্তাই উপজেলায় কিছু কিছু এলাকায় মাটি ধসে কয়েকটি বসতঘর ধসে পড়েছে। রাইখালী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এসএম নাছির উদ্দীন জানান, রাইখালী রিফিউজি পাড়া, বড় ঝিরিপাড়া ও রাইখালী বাজার এলাকায় পাহাড় ধসে টিুট, ভট্ট, জাহাঙ্গীর আলম, আজিম, আবদুর রশীদ, হারুন ও নেজামের ৮টি ঘর পাহাড় ধসে সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হয়েছে। বড়ইছড়ি কাপ্তাই ক্লাবের পাশের অনিল তনচংগ্যা ও চিৎমরম সিড়িঁঘাট এলাকার আরও ২টি ঘর বিধস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিষয়টি রাইখালী ইউপি চেয়ারম্যান মংক্য মারমাকে অবগত করা হয়েছে বলে তিনি জানান। কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মহিউদ্দিন জানান, রাইখালীর ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের খবর জানতে পেরেছেন। ক্ষতিগ্রস্থদের দ্রুত নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এব্যাপারে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান বলেন, একটি প্রাণও যাতে ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে তার জন্য বৃষ্টির মধ্যে সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে প্রশাসন উদ্ধার তৎপরতায় মাঠে কাজ করছে। তিনি বলেন, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল উপজেলা গুলোকেও ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাঙ্গামাটি শহর ও উপজেলায় মোট ১৮২ আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের খাবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় ৫ সেনাসদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর পরের বছর ২০১৮ সালে জেলায় নানিয়ারচর উপজেলায় ১২ জুন পাহাড় ধসে আরো ১১ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। এবছর যাতে সে দিনের পুনরাবৃত্তি না ঘাটে তার জন্য প্রশাসনের জোর তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।