দুই পুরোহিতকে পেটালো কাউন্সিলর পুত্র, ক্ষমা চাইলেন কাউন্সিলার পরে সমঝোতা

রাঙ্গামাটি

॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥

তুচ্ছ ঘটনায় দুই পুরোহিতকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে একদল ছাত্রলীগকর্মী, যারপ নেতৃত্বে ছিলেন ওয়ার্ড ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নাহিদ, যে রাঙ্গামাটি পৌরসভার ১,২,৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর জোৎস্না আক্তারের পুত্র। এই হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির সনাতন সমাজ।

হামলার শিকার দুই পুরোহিত হলেন রাঙ্গামাটি শহরের শ্রী শ্রী গীতাশ্রম মন্দিরের পুরোহিত পন্ডিত মিঠুন চক্রবর্তী ও ছোটন চক্রবর্তী, সম্পর্কে তারা আপন দুই সহোদর।

ঘটনাটি সোমবার রাতের। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি আসা পাহাড়ীকা পরিবহনে সংঘটিত হয় এবং রাতে স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি শাওয়াল উদ্দিন এর অফিসে সমঝোতা করা হয়।

হামলার শিকার পুরোহিত ছোটন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের অক্সিজেন বাসস্টেশন থেকে সন্ধ্যায় ৫.২০ মিনিটের পাহাড়ীকা পরিবহনের একটি বাসে করে আমি ও আমার ভাই পন্ডিত মিঠুন চক্রবর্তী রাঙ্গামাটি আসছিলাম। বাসে একজন একজন হিন্দু ধর্মীয় গুরু(সাধু) ছিলেন। পেছন থেকে সাইফুল নামের একজন যাত্রী তাকে উদ্দেশ্য করে নানান কটুক্তি করছিলেন। আমরা তাকে বারণ করায় সে ক্ষুদ্ধ হয় এবং মোবাইলে কাদেরকে যেনো জড়ো হওয়ার নির্দেশ নেয়। বাসটি যখন রাত আটটার দিকে রাঙ্গামাটি শহরের পুরাতন বাস স্টেশন এলাকায় পৌঁছায় তখন ২৫/৩০ জন ছেলে হঠাৎ বাসে উঠে এবং সাইফুলের নেতৃত্বে আমাদের দুই ভাইকে ব্যাপক মারধর শুরু করে। আমরা দুই ভাইয়ের শরীরের বিভিন্ন অংশে তারা কিল ঘুষি এবং লাঠি দিয়ে আঘাত করলে আমার গুরুতর আহত হই। এসময় তারা ধর্মীয় উস্কানিমূলক নানান কটুক্তিও করতে থাকে। যাত্রীদের হস্তক্ষেপে আমরা প্রাণে বেঁচে যাই এবং আমাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে রাতে আমাদেরকে জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি শাওয়ালউদ্দিনের অফিসে ডেকে নেয়া হয় এবং সেখানে অভিযুক্ত সাইফুলকে তার মামা সেলিম ও মা জোৎস্না ‘শাসন’ করেন এবং আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন । তাদের অনুরোধে আমরা আইনগত কোন পদক্ষেপ নেইনি।’

ছোটন জানান,আগামী শুক্রবার অনুষ্ঠিতব্য তার নিজের বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রাঙ্গামাটি ফিরছিলেন তারা দুই ভাই।

রিজার্ভবাজারের শ্রী শ্রী গীতাশ্রম মন্দির কমিটির সভাপতি আশীষ দাশ গুপ্ত জানিয়েছেন, বিষয়টি খুবই দু:খজনক এবং রাঙ্গামাটিতে এই ধরণের ঘটনা এটাই প্রথম। ঘটনার পর দোষী ব্যক্তির পরিবার, কাউন্সিলর জোৎস্না ও তার ভাই সেলিমসহ সবাই অপরাধীকে নিয়ে শাওয়ালের অফিসে আসে এবং সেখানে সে (সাইফুল) পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই ধরণের কোন ঘটনা ঘটালে তার দায় তার মা ও মামা নিবে বলেও তারা লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা তাই কঠোর কোন পদক্ষেপ নিইনি।’

রাঙ্গামাটি পৌর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক অপু শ্রীং লেপচা জানিয়েছেন, আমি বিষয়টি শুনিনি। অবশ্যই খোঁজ নিব এবং এই ঘটনায় আমাদের সংগঠনের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

যার অফিসে সমঝোতা হয়েছে,সেই জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি মোঃ শাওয়ালউদ্দিন জানিয়েছেন,‘বাসে আসার সময় কোন একটা সমস্যা হয়েছে,এটাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। এর জের ধরে বাসে দুই পুরোহিতকে মারধর করে। এরপর পুরোহিত সমিতি,মন্দির কমিটিসহ সবাই আমার সাথে যোগাযোগ করলে,দোষী ও তাদের পরিবারকে ডেকে আনি এবং সবাইকে নিয়ে একটি সমঝোতা করে দিয়েছি। ওসি সাহেবও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। দোষীদের পরিবার দোষ স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছে। বাসে উঠে মারার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। রাঙ্গামাটিতে এই রকম ঘটনা কখনই ঘটা উচিত নয়। তবে রাঙ্গামাটির কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রন করা উচিত।’

কাউন্সিলর জোৎস্না আক্তার জানিয়েছেন, আমার ছেলে সাইফুল ও বোনের ছেলে সায়েম চট্টগ্রাম থেকে আসার পথে বাসে ক্ষিরা খাওয়া নিয়ে তারা দুই ভাই দুষ্টমি করার সময় ওদের দুজনকে দুই পুরোহিত মারধর করে। গাড়িতে অপমানিত হওয়ার কারণে সাইফুল একটা ভুল করে বসেছে। আমরা পরে বসে সবাইকে নিয়ে বিষয়টি সমাধান করেছি। ভবিষ্যতে যেনো কোন ঘটনা আর না ঘটে সেইজন্য আমরা লিখিতও দিয়েছি। বিচারের সময় আমার ভাই সেলিম এবং শাওয়াল ভাইও সাইফুলকে মারধর করে শাসন করেছে এবং সে পুরোহিতদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। বিষয়টি সুন্দরভাবে শেষ হয়েছে।’

তবে জোৎস্না আক্তার অভিযোগ করেন, ‘ঘটনার সাথে জড়িত দুই পুরোহিত স্কুলজীবন থেকে উশৃংখল এবং নানান ঘটনায় জড়িত। তারা আমার ছেলেকে বিনাকারণে মারধর করেছে বলেই আমার ছেলে ক্ষুদ্ধ হয়ে একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। যদিও তা ঠিক করেনি। এটা আমার জন্যও বিব্রতকর হয়েছে।’

রাঙ্গামাটি পুরোহিত কল্যাণ সমিতির সভাপতি নির্মল চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ‘বাসে একজন সাধুকে কটুক্তি করার প্রতিবাদ করায় দুইজন পুরোহিতকে মারধর করা হয়েছে। পরে সমঝোতা হয়েছে বলে জেনেছি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এই রকম ঘটনা ঘটা উচিত নয়।’

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক পঞ্চানন ভট্টাচার্য ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এই ধরণের ঘটনা কাম্য নয়।

রাঙ্গামাটি জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারন সম্পাদক স্বপন মহাজনের যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছেন, ‘যেহেতু বিষয়টি সমঝোতা হয়ে গেছে,সেহেতু আমি এই বিষয়ে কিছু বলতে চাইনা।’

এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সমঝোতা সভায় উপস্থিত থাকা রাঙ্গামাটির কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ কবির হোসেন জানিয়েছেন, ঘটনার খবর পেয়ে সাথে সাথেই আমি ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি শাওয়ালউদ্দিনের অফিসে উভয় পক্ষ বসে সমঝোতা করছে। যেহেতু কেউ আমাদেরকে অভিযোগ করেনি এবং তারা নিজেরাই সমঝোতা করে নিয়েছে,তাই আমাদের আর কিছুই করার ছিলোনা।’