পাহাড়ে সেনা অভিযান চালানোর দাবী সুশীল সমাজের

রাঙ্গামাটি

পাহাড়ে কিছুতেই থামছে না আঞ্চলিক দলীয় সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও টার্গেট কিলিং মিশন

॥ নন্দন দেবনাথ ॥

পাহাড়ে কিছুতেই থামছে না আঞ্চলিক দলীয় সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও টার্গেট কিলিং মিশন। প্রতিনিয়ত পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সংগঠন গুলোর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত হত্যা, গুম, অপহরণ ও চাঁদাবাজীর মহড়া চলমান রয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নিরাপত্তা নেই পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীর সদস্যরাও নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত শান্তি প্রতিষ্ঠায় কর্মরত সেনা সদস্যের উপর গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার রুমায় পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠায় টহলরত সেনা সদস্যদের উপর হামলা চালায় আঞ্চলিক গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাথারি গুলিতে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সেনাবাহিনীর টহল কমান্ডার সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন এবং সৈনিক ফিরোজ ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। সেনা বাহিনীর পাল্টা গুলিতে তিন সন্ত্রাসী নিহত হয়। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের তৎপরতা ও সেনা অভিযান বাড়ানোর দাবী।

আঞ্চলিক ৫ টি দলের সন্ত্রাসী হামলা ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে পার্বত্য অঞ্চলে এক হাজারের বেশী মানুষ নিহত ও দেড় হাজারের মতো অপহরণ ও আহত হয়েছে। শুধুমাত্র গত এক বছরে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় অন্ততঃ ১৮ জন নিহত, অস্ত্রসহ আটক ৩২ ও বিপুল পরিমান ভারী মারনাস্ত্রের গুলি, এ কে ২২ রাইফেল, একে-৪৭সহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম উদ্ধার উদ্ধার এবং এলাকা আধিপত্য বিস্তারের জন্য অন্তত ৭/৮ বার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে।
পার্বত্য রাঙ্গামাটির প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিনিয়ত সোচ্চার রয়েছি। পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র যতদিন উদ্ধার হবে না ততদিন এই রকম সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চলবে। তিনি বলেন, পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রের কারণে পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ খুবই সংকিত। পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর প্রয়োজন এবং অতিসত্তর র‌্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দাবী জনান।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে যে ঘটনা গুলো ঘটছে তা কারো কাম্য নয়। তিনি বলেনা, পার্বত্য অঞ্চলে এতো গুলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষা কারী বাহিনী থাকতে কেন এই রকম ঘটনা ঘটবে। তিনি বলেন, আমরা পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চায়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যদি সঠিক ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতো তাহলে সন্ত্রাসীরা কোন দিনই সাহস পেতো না। তিনি পার্বত্য অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা আরো জোড়ালো কার দাবী জানান।

খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার সেনা হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে আমার কন্ঠ সব সময় সোচ্চার ছিলো। আমরা প্রতিনিয়ত পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সরকারকে দাবী জানিয়ে আছি। তিনি এই ধরনের নেক্কার জনক ঘটনার জন্য তীব্র নিন্দা জানান। তিনিবলেন, সেনাবাহিনীর পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রতিণিয়ত কাজ করে গেছে। তারই ধারবাহিকতায় পার্বত্য অঞ্চলের সেনাবাহিনী পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানোর ফলে পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘদিন আঞ্চলিক দল গুলোর তৎপরতা বন্ধ ছিলো। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে পাহাড়ের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আবারে পাহাড়ের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে করে পাহাড়ের মানুষের শান্তি আবারো বিঘিœত হচ্ছে। তিনি পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান আরো জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানান।

গত বছর ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারী খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গায় দেশীয় অস্ত্রসহ এক যুবক আটক। ১২ জানুয়ারী রাঙ্গামাটি রাজস্থলীতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ জে এস এস কর্মী আটক। ১৯ জানুয়ারী বিলাইছড়িতে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৭জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী।

ফেব্রুয়ারী মাসে ১১ তারিখ লামায় ছাত্রী অপহরণ। ১৬ ফেব্রুয়ারী রাঙ্গামাটি জুরাছড়িতে সেনা অভিযানে অস্ত্রসহ একজন আটক। ১৮ ফেব্রুয়ারী বাঘাইছড়িতে অধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে গভীর রাতে গুলিবিনিময়। ২৫ ফেব্রয়ারী প্রকাশ্য দিবালোকে বাঘাইছড়ি রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার সমর বিকাশ চাকমাকে গুলি করে হত্যা।

মার্চ মাসে ২ তারিখে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় অস্ত্র, গুলি, ম্যাগজিন, নগদ অর্থসহ ৪ সন্ত্রাসীকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী।
মার্চ মাসের ২ তারিখে খাগড়াছড়ি দীঘিনালায় অস্ত্র, গুলি, ম্যাগজিন, নগদ অর্থসহ চার সন্ত্রাসী আটক। ৪ মার্চ রাঙ্গামাটির লংগদুতে নদীতে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার। ১৫ মার্চ কাপ্তাই রাইখালীতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ একজন আটক।

এপ্রিল মাসে ১ তারিখে রাঙ্গামাটি বাঘাইছড়িতে সহকর্মীর গুলিতে জে এস এস এমএন লারমা দলের সশস্ত্র কমান্ডার বিশ্ব চাকমা ওরফে যুদ্ধ নিহত। ১০ এপ্রিল রাজস্থলী সীমান্ত সড়কে ১ শ্রমিকের লাশ উদ্ধার।

মে মাসের ৮ তারিখে নানিয়ারচরে চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার হত্যাকান্ডের আসামী অস্ত্রসহ আটক করেছে যৌথবাহিনী।
জুন মাসের ১৫ তারিখে রাঙ্গামাটি জুরাছড়ি উপজেলার লুলাংছড়িতে দূর্বৃত্তদের গুলিতে কার্বারী (গ্রাম প্রধান) নিহত। ২০ জুন বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এক যুবককে গুলি করে হত্যা। ২৭ জুন খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ইউপিডিএফ’র কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা। ২৮ জুন বান্দনবানের নাইক্ষংছড়ির সীমান্তে অজ্ঞাত পুরুষের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার।

জুলাই মাসের ১০ তারিখে রাঙ্গামাটি রাইখলীতে সন্ত্রাসী দলের দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে ১জন নিহত। একই দিনে খাগড়াছড়ির গুইমারাতে সেনাবাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ ৪জন ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী আটক। ১৮ জুলাই খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খল কুমার ত্রিপুরা নামে এক যুবক নিহত। ১৯ জুলাই বান্দরবানে এক পল্লী চিকিৎসককে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা। ২৫ জুলাই রাঙ্গামাটি মগবান এলাকায় বাসিরাম তংচঙ্গ্যা নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।

আগষ্ট মাসের ১ তারিখে রাঙ্গামাটি সেনাবাহিনীর অভিযানে এ কে ২২ রাইফেল, ৭৭ রাউন্ড গুলি, এ্যামুনিশান, ১টি ম্যাগজিনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার। ৬ আগষ্ট খাগড়াছড়ির পানছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ইউপিডিএফ মূল দলের গুলি বিনিময় অস্ত্র ও এ্যামেনিশানসহ এক সন্ত্রাসী আটক। একই দিনে রাঙ্গামাটি রাজস্থলীতে জে এস এসের মূল দলের কালেক্টরকে আটক করলো যৌথ বাহিনী। ১০ আগষ্ট খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে সেনা অভিযানে ইউপিডিএফ মূল দলের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আটক, চাইনিজ পিস্তল, ম্যাগজিন, ৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার।২০ আগষ্ট বান্দরবান বিজিবি অভিযানে ৩টি মর্টাল শেল ও ২টি আর এল গোলা উদ্ধার। ২৩ আগষ্ট রাঙ্গামাটির জুরাছড়িতে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় সেনা অভিযানে একে-৪৭সহ শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতার। ২৩ আগষ্ট বান্দরবানে রুমায় দূর্গম এলাকার মাটির নিচে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ১২টি মর্টাল শেল উদ্ধার। ২৪ আগষ্ট রাঙ্গামাটি জীবতলী এলাকা সেনা অভিযানে ২টি অত্যাধুনিক আগ্নেযাস্ত্র ও তাজা গুলিসহ ১জন আটক। ২৭ আগষ্ট খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ইছাছড়ি এলাকার পাহাড়ের ঢালুদে যুবকের মরদেহ লাশ উদ্ধার।

সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে সেনা ও বিজিবি’র যৌথ অভিযানে জে এস এসের সন্ত্রাসী গ্রুপ সাথে ব্যাপক গুলি বিনিময়। ১৭ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি বাঘাইছড়ির মধ্যম বঙ্গলতলী এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে একজন নিহত। ১৮ সেপ্টেম্বর বাঘাইছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাসায় নিহত হয় সুরেশ চাকমা।

অক্টোবর মাসের ৬ ও ৭ তারিখ দুইদিন রাঙ্গামাটিতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ ৭জন গ্রেফতার। ১৬ অক্টোবর রাঙ্গামাটি কাপ্তাই চিৎমরমে আওয়ামীলীগের ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে গুলি করে হত্যা। ২৫ অক্টোবর রাঙ্গামাটি কাপ্তাইয়ে অস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলিসহ ১জন আটক।

নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ২নং গাইন্দা ইউনিয়নের তাইতংপাড়ায় নিউরো সার্জন ডা. রেনিন সু তালুকদারকে হত্যা উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলি। ২৩ নভেম্বর বান্দরবানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আওয়ামীলীগের নেতা উথোয়ানু মারমা নিহত, স্ত্রী গুলিবিদ্ধ। ২৬ নভেম্বর রাঙ্গামাটি বন্দুক ভাঙ্গায় সন্ত্রাসীদের আস্তানায় অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী।

ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে বান্দরবান সদর উপজেলার ডলুপাড়া থেকে অপহৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বান্দরবান জেলা কমিটির সদস্য ও বান্দরবান থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পুশৈথোয়াইর অপহরণের পর হত্যা, মাটি খুড়ে লাশ উদ্ধার। ১৪ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলায় অস্ত্রের মুখে দুই গ্রামবাসীকে অপহরণ। ২৯ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির ২ কিলো নামক স্থানে আঞ্চলিক দুই গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধে নিহত-২ জন, আহত-১, অভিযান চালিয়ে একে ৪৭ রাইফেল উদ্ধার। ৩০ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি দীঘিনালা সেনাবাহিনীর অভিযানে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীকে আটক।